শান্তুনু চৌধুরী :
১৬ ফেব্রুয়ারি কক্সবাজারে একশো দুইজন ইয়াবা ব্যবসায়ীর আত্মসমর্পণের কথা মনে আছে নিশ্চয়। তবে সংবাদ জানার পাশাপাশি যারা সংবাদের ভিডিওটি দেখেছেন তারা একটি দৃশ্য খেয়াল করে থাকবেন– সেই ছবিতে সাবেক সংসদ সদস্য বদির চার ভাইসহ যাদের দেখা গেছে তাদের বেশিরভাগেরই চুল দাড়ির সঙ্গে মাথায় টুপি, অনেকে পাঞ্জাবি পরা। এটার ভালো দিকটা হচ্ছে, একটা মন্দ জীবন পেরিয়ে এরা ভালোর দিকে যাত্রা শুরু করেছে এবং আমরা ধর্ম-কর্ম পালন করাকে ভালো হওয়ার লক্ষণ বলেই ধরে নিই। কিন্তু মুশকিল তখনই বাদে, ধার্মিক আর ‘বক ধার্মিকে’র মধ্যে যখন পার্থক্য করা মুশকিল হয়ে পড়ে।
৪৪ বছর বয়সী ওমর ফারুক। ঢাকার ধামরাইয়ের হরিদাসপুর ধোপের বাড়ি জামে মসজিদে ১৫ বছর ইমামের দায়িত্ব পালন করেছেন। পাশাপাশি ওই এলাকায় হাফেজিয়া নুরানি মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করতেন। সেখানে থেকে পড়াতে গিয়ে তিনি জড়িয়ে পড়েন ইয়াবা ব্যবসায়। ১৩ ফেব্রুয়ারি কক্সবাজার থেকে ঢাকাগামী একটি বাসে তল্লাশি চালিয়ে তাকে গ্রেফতার করে চট্টগ্রামের কোতোয়ালি থানা পুলিশ। একযুগ ধরে কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রাম নগরীতে ইয়াবা পাচার করছেন ষাট বছর বয়সী বৃদ্ধ রশিদ আহম্মদ। ইয়াবা পাচারের ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার চোখ ফাঁকি দিতে তার প্রধান কৌশল হচ্ছে ধর্মীয় পোশাক। সম্প্রতি চট্টগ্রাম মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ একটি মোটরসাইকেলের ভেতর থেকে ৩৫ হাজার ইয়াবাসহ একজনকে আটক করেছিল। জিজ্ঞাসাবাদে ওই পাচারকারী পুলিশকে জানিয়েছিল, টেকনাফের একটি মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ইয়াবাগুলো নগরীতে পাঠিয়েছেন। ২৬ জানুয়ারি চট্টগ্রামের মইজ্জ্যারটেক এলাকায় ইয়াবা পাচারের সময় মসজিদের এক ইমামকে গ্রেফতার করা হয়। কর্ণফুলীতে ইয়াবাসহ গ্রেফতার করা হয় এক হাফেজকে। বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি অভিনব উপায়ে কোরআন শরিফের ভেতরে করে পাচারের সময় মাদকের একটি চালান আটক করে। আটক করা হয় তিনজনকে। কক্সবাজার থেকে এক ব্যক্তিকে আটক করা হয়, যার মাথার পাগড়ির মধ্যে ৬০০০ ইয়াবা লুকানো ছিল। একই সময়ে এক কারবারির কাছ থেকে আরেকজনের কাছে পৌঁছে দিতে গিয়ে ইয়াবা নিয়ে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে মসজিদের এক ইমাম। এগুলো গেলো কয়েক মাসের পত্রিকার পাতায় আসা কয়েকটি উদাহরণ মাত্র। ‘বক ধার্মিক’রা ধর্মকে কীভাবে ব্যবহার করছে তার কয়েকটি নমুনা মাত্র। আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে কক্সবাজার জেলার পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেন বলেছিলেন, একসময় সে এলাকাটি ছিল এমন, বিয়ের পাত্র ইয়াবা ব্যবসা করে জেনেও তার কাছে মেয়ে বিয়ে দিতো। একটি সমাজে কত বড় পচন শুরু হলে সেটি হতে পারে। অবশ্য মিয়ানমার থেকে সেই রুটে মাদক পাচারের ইতিহাস বেশ পুরনো। ছেলেবেলায় আমরাও দেখেছি, বয়স্করা আফিম খেতেন এবং সেই আফিম আসতো মিয়ানমার থেকে।
মিয়ানমার সবসময় আমাদের নানাভাবে ঠেকানোর চেষ্টা করে আসছিল। সমুদ্রসীমায় বিজয় অর্জন করতে না পারা, রোহিঙ্গাদের কারণে মানবিক বাংলাদেশের উদাহরণ সৃষ্টি হওয়াসহ আরও নানা কারণে তারা যেন গায়ে পড়ে ঝগড়া লাগাতে চায়। আর ইয়াবা আসে মিয়ানমার থেকে। সেটা এমনই এক মাদক, একটি জাতিকে, জাতির ভবিষ্যৎকে ঘুম পাড়িয়ে রাখার জন্য যথেষ্ট। সবসময় অস্ত্র দিয়ে ধ্বংস করতে হয় না। ধ্বংস করার জন্য মাদকও বিধ্বংসী অস্ত্র। কিন্তু কথা হচ্ছে জাতিকে বাঁচানোর কথা যারা বলবে, যারা মানুষকে সঠিক পথের নিশানা দেখাবে সেই ইমাম, হাফেজ থেকে শুরু করে সমাজের অনেক বিদগ্ধ লোকজন জড়িয়ে পড়ছে এই পেশায় শুধুমাত্র বেশি রোজগারের আশায়। ভাবছেও না জাতিকে, দেশকে কোথায় ঠেলে দিচ্ছে। এসব দেখে ভালো ইমামরা হয়তো দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। তেমনই একজন দেখলাম আফসোস করে বলেছেন, ‘খারাপ কাজের জন্য দুনিয়াতে শাস্তি তো আছেই। পরকালের ভয়াবহ শাস্তির কথাও মানুষকে স্মরণ করিয়ে দেন ইমামেরা। এতে অনেক মানুষ খারাপ কাজ থেকে দূরে থাকেন। দুঃখের বিষয়, কিছু ইমাম নামধারী ব্যক্তি খারাপ কাজে জড়িয়ে পড়ছেন। প্রকৃত ইমাম শত অভাবে থাকলেও অন্যায় পথে পা বাড়াবেন না।’
শুধু যে ধর্মীয় লেবাস নিচ্ছে তা নয়। বাবুর্চি, সাপুড়ে, পর্যটকসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ বেশি টাকার লোভে ইয়াবা পাচার করছে। মাথায় টুপি। গলায় হাজি চাদর দেখে কেউ বলবে না তারা কোনও খারাপ কাজের সঙ্গে যুক্ত। সাধারণত এই ধরনের পোশাক পরা লোকজনকে সন্দেহের আওতায় রাখে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। তাই তারা এই বেশ নেয়। যদিও এখন ধারণা পাল্টেছে। ধরাও পড়ছে।
বর্তমান সরকার এই মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর শুরু থেকেই মাদকের বিরুদ্ধে বেশ সোচ্চার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছেন। তবে অনেক সময় ইয়াবা ব্যবসায়ীরা ‘পাল্টা গুলি’ করে মৃত্যুবরণও করেছে। এর ফলে খানিকটা সমালোচনাও হয়।
টিআইবি উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছিল, ‘প্রধানমন্ত্রীর মাদকবিরোধী অভিযান চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ আমাদের আশান্বিত করেছে, একই সঙ্গে আমরা নিশ্চিত হতে চাই যে, বিনা বিচারে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ আর কাউকে নিহত হতে হবে না।’
যারা ধর্মকে ব্যবহার করে ইয়াবা পাচার বা ইয়াবা কারবারের মতো কাজ করছেন তারা কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ধর্মকর্মের ধারেকাছে নেই। কিন্তু লেবাসটা নিচ্ছে ধর্মীয়। কারণ, এই লেবাসের লোকজনকে সাধারণত মানুষ সম্মান করে। আসলে খারাপ মানুষগুলো ধর্ম বা ভালো মানুষের লেবাস ধরছেন খারাপ কাজ করে পার পাবার জন্য। এখন ইয়াবার পাচার বা বিস্তার ঠেকাতে পারে একমাত্র জনসচেতনতা। গ্রামে গ্রামে কিন্তু এর বিষ ঢুকে যাচ্ছে। বেশি করে জনসচেতনতা আর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর নজরদারিই পারে সেটি ঠেকাতে। পাশাপাশি আত্মসমর্পণের মতো ঘটনাও ইতিবাচক হিসেবে দেখছি। কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রামে ঢোকার প্রবেশপথ কর্ণফুলী ব্রিজ এলাকা যেহেতু কোতোয়ালি থানার অধীনে, সে কারণে সম্ভবত সেই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ মহসিনের উদ্বেগটা বেশি এবং তার সম্প্রতি মসজিদে মসজিদে গিয়ে মানুষকে সচেতন করাটা একটা ভালো উদ্যোগ মনে হয়েছে। বিশেষ করে প্রতি শুক্রবার জুমার নামাজের সময়। এ বিষয়ে তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। তিনি লিখেছেন, ‘কে কী ভাববে ভাবিনি। মনে আসলো, ভালো লাগলো, তাই করেই ফেললাম। আমার দেখা এটা প্রথম। হয়তো দেশের ইতিহাসেও প্রথম। মসজিদের মধ্যেই মুসল্লিদের শপথ করালাম। আমরা সবাই মসজিদকে সম্মান করি, ভালোবাসি। পারতপক্ষে কেউ এখানে মিথ্যা বলে না। লাভ লেইন জামে মসজিদের আট শতাধিক মুসল্লি ইমাম সাহেবের কাছে শপথ করলেন তারা মাদক নেবেন না, ইভটিজিং করবেন না। শপথের সময় অধিকাংশই খুশি হয়েছেন। কেউ কেউ বিরক্তও হয়েছেন। কিন্তু আমি জানি এই বিরক্তিটাও একদিন তার খুশির কারণ হবে।’
প্রতি জুমা বারে তিনি কাজটা করেন বলে জানি। এটি একটি ভালো উদ্যোগ হতে পারে। প্রতি থানায়, গ্রামেগঞ্জে পুলিশ ‘লাঠির ভয়’ দেখানোর পাশাপাশি সমবেদনা ভরে মানুষকে মাদকের কুফল বোঝাতে পারে, মাদক যে একটি পরিবারকে কীভাবে ধ্বংস করতে পারে, পরিণতি কী হয় সেটা বোঝাতে পারে। তবে দেশের পাশাপাশি সীমান্তে যারা পাহারায় রয়েছে বিজিবি, তাদের কঠোর হতে হবে আরও বেশি। কারণ, ইয়াবা আসে মিয়ানমার থেকে। আর তারা চায় এই দেশ একটি ঘুমন্ত জাতির দেশে পরিণত হোক। যেমনটি চেয়েছিল পাকিস্তানিরা। এ দেশকে মেধাশূন্য করতে। ঘুমন্ত ও মেধাশূন্য জাতি কোনোদিন উঠে দাঁড়াতে পারে না। উন্নত দেশে এদের কোনও স্থান নেই। কাজেই এখনই সময় ইমাম, মুয়াজ্জিন বা ধর্মীয় নেতাদের উদ্যোগে একটি মাদকমুক্ত সমাজের জন্য কাজ করার। ধর্মের শৃঙ্খল জীবনের কথা, সুন্দর জীবনের কথা, শান্তির কথা সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে হবে। আর স্লোগানে স্লোগানে বলে দেওয়া, ‘চলো যাই যুদ্ধে-মাদকের বিরুদ্ধে’।
লেখক: সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-